নেদারল্যান্ডের ইতিহাস

ডঃ মৃণাল কান্তি চট্টোপাধ্যায়

Biswarup Ghoshal
5 min readJan 17, 2021

নেদারল্যান্ড বা হল্যান্ড দেশ টি পশ্চিম ইউরোপের একটি উন্নত দেশ। নেদারল্যান্ড দেশ টি ১২ টি প্রদেশ নিয়ে গঠিত। ভৌগলিক দিক দিয়ে এই দেশটির পূর্ব দিকে জার্মানি এবং দক্ষিণ দিক দিয়ে বেলজিয়াম।এই দেশটি উত্তর সাগরের উপকুলে অবস্থিত। জাতি গত দিক দিয়ে এই দেশ টির নাগরিকদের ডাচ বলা হয়। নেদারল্যান্ড শব্দের বাংলা অর্থ হল নিম্নভূমি।সমুদ্রতল থেকে খুব উঁচুতে এই দেশটির অবস্থান নয়।

এই দেশ টির ইতিহাস খুব বর্ণময়।প্রাচীন কালে এই দেশটিতে কেলটিক ও জার্মান গ্রোত্রের লোকেরা বাস করত। শক্তিশালী রোমান শাসকেরা এই দেশটিকে দখল করে নিয়েছিল। দীর্ঘ দিন নেদারল্যান্ড রোম্ সাম্রাজ্যভুক্তও ছিল। স্বাভাবিক নিয়মে শক্তিশালী রোমান শাসকদের পতন হয়েছিল।তাদের পতনে গুরুত্ব পূর্ণ ভুমিকা নিয়েছিল ক্যারলিঞ্জিও শাসকেরা। এই বংশের শ্রেষ্ঠ শাসক ছিলেন মহান শার্লামেন বা গ্রেট চার্লস। স্বাভাবিক কারনে নেদারল্যান্ড শার্লামেনের শাসনাধীন হয়ে পড়েছিল। শার্লামেনের মৃত্যুর পর ক্যারলিঞ্জিয় সাম্রাজ্যের পতন শুরু হয়েছিল। কারন শার্লামেনের পুত্র লুই দ্য পায়াস পিতার মত শক্তিশালী শাসক ছিলেন না। ফলে তাঁর জীবিত কালে তাঁর পুত্রদের মধ্যেই সিংহাসন নিয়ে রক্তাত্ব সংগ্রাম হয়েছিল। পরিনামে ৮৪৩ সালে ভাদুর্নের সন্ধি দ্বারা লুয়ের তিন পুত্রদের মধ্যে বিশাল সাম্রাজ্য তিন ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়েছিল। নেদারল্যান্ড ভাগে পড়েছিল লুয়ের প্রথম পুত্র লোথায়ের ভাগে।

ইতিহাসের পথ ধরে ইউরোপের প্রথম শ্রেণীর শক্তি হিসেবে স্পেনের উত্থান ইতিহাসে নতুন অধ্যায়ের জন্ম দিয়েছিল। স্পেনের শক্তিশালী শাসক ছিলেন পঞ্চম চার্লস। তাঁর সময়ে নেদারল্যান্ড স্পেনের শাসনাধীনে চলে আসে। হ্যাপ্সবারগ শাসকেরা. দীর্ঘ দিন নেদারল্যান্ড কে শাসন করেছিল। স্পেনীয় দের শাসনে নেদারল্যান্ডের অগ্রগতি ব্যাহত হয় নি। স্পেনিয়দের নিয়ন্ত্রনে নেদারল্যান্ডের শাসনব্যবস্থা খুব উন্নত ছিল।এই সময় থেকে ওলন্দাজ বা ডাচরা শক্তিশালী জাতি হিসেবে নিজেদের তৈরি করেছিল। কিন্ত এই. সময়. থেকে নেদারল্যান্ডে ধর্ম জীবনে পরিবর্তন এসেছিল। স্পেনের শাসকেরা ধর্মের দিক দিয়ে ক্যাথলিক ছিলেন। কিন্ত নেদারল্যান্ডে প্রোটেস্ট্যান্ট মতবাদ ক্রমশ জনপ্রিয়তা লাভ করেছিল। তবে ওলন্দাজদের প্রোটেস্ট্যান্ট দের মধ্যে বিভিন্নতা ছিল। ওয়াইক্লিফ এবং জন হাসের মতবাদ নেদারল্যান্ডে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল। ইরাসমাস, জুইংলি, ক্যালভিনের অনুগামীদের সেখানে অভাব ছিল না। আনাব্যাপিস্টদের গুরুত্ব ছিল। তবে নেদারল্যান্ডে ক্যালভিনদের প্রভাব বেশি ছিল। কারন নেদারল্যান্ডের অভিজাত পরিবারের সন্তানেরা সুইজারল্যান্ডের জেনেভা নগরীতে উচ্চ শিক্ষা লাভের জন্য যেত এবং ক্যালভিন মতবাদের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে দেশে ফিরে আসত। ১৫৮১ সালে ক্যালভিনবাদিদের নেতৃত্বে নেদারল্যান্ডের সাতটি প্রদেশ স্পেনের কাছ থেকে স্বাধীনতা পেয়েছিল।১৬১৮ সালে ক্যাথলিক ও প্রোটেস্ট্যান্টদের মধ্যে বিরোধকে কেন্দ্র করে ত্রিশ বছর ব্যাপী যুদ্ধ যে শুরু হয়েছিল তার সমাপ্তি হয়েছিল ১৬৪৮ সালে ওয়েস্টফেলিয়া সন্ধি দ্বারা। ফলে এই সন্ধি দ্বারা স্পেন নেদারল্যান্ডকে স্বাধীনতা দিতে বাধ্য হয়েছিল। স্বাধীন দেশ হিসেবে নেদারল্যান্ডের স্বর্ণ যুগ শুরু হয়েছিল।

একটা জাতি ইতিহাসে তখনি শক্তিশালী হিসেবে পরিগণিত হয় যখন সে আর্থিক এবং সামরিক দিক দিয়ে শক্তিশালী হয়ে উঠে। ওলন্দাজরা বানিজ্যকে গুরুত্ব দিয়েছিল। বানিজ্যের সুত্র ধরে ১৫৯৫ সালে প্রথম উত্তমাশা অন্তরীপ হয়ে ওলন্দাজ বনিকেরা ভারতে এসেছিল। এর আগে তারা দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার যাভা,সুমাত্রা ও ইন্দোনেশিয়াতে নিজেদের বানিজ্যকে প্রতিষ্ঠা করেছিল। অলন্দাজ বনিকেরা যখন ভারতে এসেছিল তখন ভারতের শাসক ছিলেন. শক্তিশালী মোঘলরা।ভারতের মোঘল শাসকেরা সামরিক দিক দিয়ে বিশেষ করে স্থল বাহিনীর উপর বেশী গুরুত্ব দিয়েছিলেন।কিন্ত তাদের ত্রুটি ছিল সমুদ্রপথকে সুরক্ষিত করার জন্য নৌ শক্তির উপর গুরুত্ব দেওয়ার প্রয়োজন বোধ করেন নি।এর জন্য পরবর্তী সময়ে তাদের খেসারত দিতে হয়েছিল।কারন বিদেশী বনিকেরা এর সুযোগ নিয়ে সমুদ্র পথে ভারতের উপকুলে চলে এসেছিল। পর্তুগীজ, ওলন্দাজ, ইংরেজ বনিকেরা ভারতে প্রবেশ করেছিল।

১৬০২ সালে ওলন্দাজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী গঠিত হয়েছিল। নেদারল্যান্ডের পার্লামেন্ট Dutch States General একটি সনদের মাধ্যমে ওই কোম্পানীকে যুদ্ধ করার,সন্ধি করার, নতুন এলাকা দখল করার এবং দুর্গ নির্মাণ করার অধিকার দিয়েছিল। ১৬০৫ সালে ওলন্দাজ কোম্পানী পর্তুগীজদের কাছ থেকে অনেক এলাকা দখল করে নিয়েছিল। ১৬১৯ সালে ডাচরা ইন্দোনেশিয়ার জাকার্তা অধিকার করেছিল।১৬৩৯ সালে ভারতের গোয়াকে তারা অবরোধ করেছিল। সুমাত্রা,যাভায় ওলন্দাজ বনিকেরা নিজেদের আধিপত্যকে প্রতিষ্ঠা করেছিল। তারা ওই সব এলাকায় নিজেদের আর্থিক কর্ম কেন্দ্র গড়ে তুলেছিল।

ওলন্দাজ বনিকদের ভারতের দিকে নজর ছিল। তারা গুজরাট, করমন্ডল উপকুলে এবং বাংলা বিহার ও উড়িষ্যার বিভিন্ন স্থানে ওলন্দাজ বনিকেরা তাদের কুঠি নির্মাণ করেছিল। এই সব কুঠি গুলির মধ্যে মুসলিপত্তম, পুলিকাট, সুরাট, চুচড়া, কাশিমবাজার , পাটনা, বালেশ্বর অঞ্চলের কুঠি ছিল বিখ্যাত।সমগ্র সপ্তদশ শতক জুড়ে ওলন্দাজ বনিকেরা প্রাচ্যের মসলা বানিজ্যের উপরে তাদের একচেটিয়া বানিজ্যকে ধরে রেখেছিল। সুরাট বন্দর থেকে ওলন্দাজ বনিকেরা মধ্যভারতে উৎপাদিত নীল এবং বাংলা, বিহার, গুজরাট ও করমন্ডল উপকুল থেকে তারা কাঁচা রেশম, তুলা, আফিং ইত্যাদি রপ্তানি করেছিল। ১৬৩০ সাল থেকে ১৬৫৮ সালের মধ্যে ওলন্দাজ বনিকেরা ভারতে ব্যাপক বানিজ্য করেছিল। ১৬৯০ সালের পর থেকে তাদের প্রধান বানিজ্য কেন্দ্র হয়ে উঠেছিল করমন্ডল উপকুলের নেগাপত্তম।

কিন্ত সপ্তদশ শতকের শেষ লগ্ন থেকে ওলন্দাজ বনিকদের এই প্রভুত্বের পথে বাধা হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী ফলে ইংরেজ কোম্পানী ও ওলন্দাজ কোম্পানীর মধ্যে সম্পর্ক ক্রমশ খারাপ হয়েগিয়েছিল। ওলন্দাজ বনিকেরা নিজেদের শক্তিকে ধরে রাখার জন্য সুরাটের সঙ্গে ইংরেজদের বানিজ্য ঘাঁটি বোম্বাই এর যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছিল। এমন কি ওলন্দাজরা বঙ্গোপসাগরে তিনটি বানিজ্য জাহাজকে দখল করে নিয়েছিল। সেজন্য এই দুই বিদেশী শক্তির মধ্যে সম্পর্ক তলানীতে চলে যায়। এই সময়ে ওলন্দাজরা ভারতের থেকে ইন্দনেশিয়ার দিকে বেশী গুরুত্ব দিয়েছিল। ব্রিটিশদের অগ্রগতিকে বাধা দেওয়ার মতো শক্তি তখন তাদের ছিল না। ব্রিটিশ বানিজ্য সংস্থা ক্রমে ভারতের বাজারকে দখল করে নিয়েছিল। ১৬৯৮ সালে চুঁচড়ার ওলন্দাজ বানিজ্য কুঠির প্রধান. বাংলার সুবেদার আউরঙ্গেবের পুত্র আজিম উস সানের কাছে আবেদন করেন ব্রিটিশ বনিকদের বেশী সুবিধা দেওয়া হচ্ছে। কারন ওলন্দাজ বনিকদের বছরে বানিজ্যের. সাড়ে তিন শতাংশ কর দিতে হয়, সেখানে ইংরেজ বনিকেরা দেয় বছরে মাত্র ৩০০০ টাকা। এই অসাম্য করের বিরুদ্ধে তিনি প্রতিবাদ করেছিলেন। কিন্ত তার দাবি গুরুত্ব পায় নি। কারন এই সময় ব্রিটিশ বনিকেরা বাংলার অর্থনীতির উপর এত প্রভাব ফেলেছিল যে বাংলার শাসকেরা ইংরেজ কোম্পানির হাতের পুতুল হয়ে গিয়েছিল। ১৭৫৭ সালে পলাশির যুদ্ধে ইংরেজ কোম্পানির হাতে বাংলার নবাব পরাজিত হয়েছিলেন। যুদ্ধের বেইমানীর পুরস্কার হিসেবে মীরজাফর বাংলার সিংহাসনে বসেছিলেন। প্রকৃত ক্ষমতা ইংরেজ কোম্পানির হাতে চলে গিয়েছিল। মীরজাফর ব্রিটিশ দের কবল থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য চেষ্টা করেছিলেন। তাদের নিয়ন্ত্রন নবাবের কাছে অসহ্য হয়ে উঠেছিল। বাংলার ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির গভর্নর হলওয়েল এই সময় অভিযোগ করেছিলেন যে মীরজাফর তাদেরকে উচ্ছেদ করার জন্য ওলন্দাজদের সাহায্য চেয়েছিলেন। তিনি ওলন্দাজদের সঙ্গে গোপনে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে চক্রান্ত করেছিলেন। সেজন্য ওলন্দাজরা নিজেদের বানিজ্য ঘাঁটি গুলোকে রক্ষা করার জন্য বাটাভিয়া ও ইন্দোনেশিয়া থেকে সৈন্য এনেছে। পরিনামে ১৭৫৯ সালে ওলন্দাজদের সঙ্গে ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর বিদেরাতে যুদ্ধ হয়েছিল এবং ওলন্দাজরা পরাজিত হয়েছিল। রামকৃষ্ণ মুখোপাধ্যায় The Rise and Fall of the East India Company. গ্রন্থে বলেছেন- In1759, Dutch opposition to the growth of English influence in India collapsed completly.এরপর থেকে ওলন্দাজরা ভারত থেকে নিজেদের সরিয়ে নিতে শুরু করেছিল।১৭৮২ সালে করমন্ডল উপকুলের গুরুত্বপূর্ণ. বানিজ্য কেন্দ্র নেগাপত্তম এবং সিংহলের বানিজ্য কেন্দ্র গুলো সব ব্রিটিশদের দখলে চলে গিয়েছিল। ১৭৯৫ সালে. ব্রিটিশ রা ওলন্দাজদের ভারত থেকে বিতাড়িত করেছিল।

এই সময় ইউরোপের ইতিহাসে যুগান্তকারী ঘটনা ঘটেছিল। ১৭৮৯ সালে ফরাসী বিপ্লব কেবল ফ্রান্সের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না,সারা ইওরোপে ছড়িয়ে পড়েছিল। ফ্রান্স থেকে দীর্ঘ দিনের রাজতন্ত্রের পতন হয়েছিল এবং প্রজাতন্ত্রের সূচনা হয়েছিল। ফ্রান্স শক্তিশালি দেশ হিসেবে পরিগণিত হয়েছিল।কিন্ত কিছু দিনের মধ্যেই ফ্রান্স নেপোলিয়নের দ্বারা আবার রাজতন্ত্রের দিকে ফিরে যায়। গৌরব লোভী ফরাসী জাতিকে খুশি করার জন্য তিনি উগ্র পররাষ্ট্র নীতি অনুসরন করেছিলেন। সারা ইওরোপের উপর আধিপত্য দেখিয়েছিলেন এবং নেদারল্যান্ড কে দখল করেছিলেন।নেদারল্যন্ড হল্যান্ড নামে ফ্রান্সের অধীনে শাসিত হতে থাকে। ওয়াটারলু যুদ্ধে তিনি পরাজিত হন। কিভাবে ইওরোপের রাজনৈতিক ব্যবস্থা চলবে তার জন্য ১৮১৫ সালে ভিয়েনা সম্মেলন হয়েছিল। এই সম্মেলনে নেদারল্যান্ডের শাসন ভার দেওয়া হয় অরেঞ্জ রাজবংশকে। এখানে সাংবিধানিক রাজবংশ স্থাপিত হয়েছিল। ১৮৪৮ সালে ফেব্রুয়ারি বিপ্লবের সুত্র ধরে নেদারল্যান্ডে সংসদীয় গণতন্ত্র চালু হয়েছিল। প্রথম বিশ্ব যুদ্ধে নেদারল্যান্ড নিরপেক্ষ ছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে এই দেশ টি নিরপেক্ষ থাকলেও জার্মানি এই দেশকে দখল করেছিল। যুদ্ধের অবসানের পর এই দেশ টি অতি দ্রুত শক্তিশালী হয়েছিল। ২০১৮ সালের এক তথ্য থেকে জানা যায় যে এই দেশটি বিশ্বের দ্বিতীয় স্থান অধিকার করেছে উদ্ভাবনী শক্তির দেশ হিসেবে। এই দেশটির ৯৯ শতাংশ জনগণ শিক্ষিত।

This article is written by Dr. Mrinal Kanti Chattopadhyay, Principal, Kandra College, West Bengal, India. You can listen to his lecture which he has recently delivered in ab international webinar. You can listen to the lecture here.

--

--